ঢাকারবিবার , ২১ এপ্রিল ২০২৪
  • অন্যান্য

নরসিংদীর গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া মন্দিরের কমিটি নিয়ে দ্বন্দ

আজকের বিনোদন
এপ্রিল ২১, ২০২৪ ৩:৩৪ পূর্বাহ্ণ । ৪৯৯ জন
Link Copied!
দৈনিক আজকের বিনোদন সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

​​​​​​​নরসিংদীর গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া মন্দিরের কমিটি নিয়ে দ্বন্দ

আশিকুর রহমান :-

নৈতিকতার ইংরেজি শব্দ মোরালিটি।
লাতিন শব্দ “মোরালিটাস”থেকে মোরালিটির উৎপত্তি। যার অর্থ চরিত্র, ভদ্রতা, সঠিক আচরণ, সামাজিকতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম প্রভৃতির মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা নৈতিকতাকে একটি আদর্শিক মানদন্ড ও বলা যেতে পারে। অন্যদিকে ধর্মবোধের প্রকৃত ভিত্তিই হ’ল নৈতিকতা। নৈতিকতা কোন ব্যক্তির মধ্যে এমন আচরণ কিংবা গুনাবলি তৈরি করে , যা অপরের প্রতি ক্ষমা ও মার্জনা, উদারতা ও দানশীলতা, ধৈর্য্য, বিনয় ও নম্রতা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আর অবক্ষয় শব্দের মানে হলো ক্ষয়প্রাপ্তি। মানবজীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে হলে কিছু গুণের প্রয়োজন হয়। আর মানুষের এই গুণগুলি যখনই লোপ পায় বা নষ্ট হয় তখনই শুরু হয় নৈতিক অবক্ষয়। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে এই নৈতিক অবক্ষয়ের চরমদশা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনৈতিক মূল্যবোধের অভাবে দিন দিন সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। নৈতিক বা অনৈতিক বিবেচনা না করে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে মরিয়া হয়ে গত কয়েকদিন ধরে নরসিংদীর সনাতন ধর্মালম্বীদের শত বছরের পুরনো গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া মন্দিরে কারা নেতৃত্ব দিবে তা নিয়ে প্রকাশ্যেই চলে দ্বন্দ। এমনকি কমিটিতে স্থান পেতে অপর পক্ষকে ঘায়েল করে মিথ্যা অভিযোগের মাধ্যমে নাস্তানাবুদ করতে দেখা যায়।
গত ১৭ এপ্রিল (বুধবার) রাতে নরসিংদীর বড় বাজার সংলগ্ন শত বছরের পুরনো ঐহিত্যবাহী গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া মন্দিরে এ রকম ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় ও মন্দিরে আগত ভক্তবৃন্দরা জানান, মন্দিরটি প্রায় ১৩০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালে মন্দিরের ভক্তবৃন্দ ও দাতাদের সর্বসম্মতিক্রমে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রঞ্জিত কুমার সাহা ও ডা. দিলীপ কুমার সাহাকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট মন্দির কমিটি করা হয়। দীর্ঘদিন তারা কমিটিতে থেকে মন্দিরের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত করেন। হঠাৎ করে সভাপতি পরলোক গমন করলে অধ্যক্ষ অহিভূষণ চক্রবর্তীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি করা হয়। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর মন্দিরের ক্যাশিয়ার হরিপদ দাসকে বগলে এনে ডা. দিলীপ কুমার সাহার বিরুদ্ধে নানা যড়যন্ত্র শুরু করেন। তারা আরও জানান, কমিটি হওয়ার পূর্বে মন্দিরটি ছিল জরাজীর্ণ অবস্থায়। পরে আস্তে আস্তে মন্দিরের ব্যাপক উন্নয়ন করা হয়। এই কমিটির মাধ্যমে একটি তিনতলা বিশিষ্ট বৃহৎ বিল্ডিংও নির্মাণ করা হয়।
মন্দির কমিটির সহ-সভাপতি হরিপদ সাহা বলেন, আমরা নতুন করে কমিটি করার জন্য কমিটির উপদেষ্টা ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতির মতামতের ভিত্তিতে সকল উপদেষ্টা, কার্যকারী সদস্য, সাধারণ সদস্য, দাতা ও ভক্তবৃন্দদের ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় মন্দির প্রাঙ্গণে উপস্থিত হওয়ার জন্য আহ্বান করি। কমিটির ৭৫ ভাগ সদস্য ও ভক্তবৃন্দদের উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে কন্ঠ ভোটে রায় জুয়েলার্সের মালিক অজিত রায়কে সভাপতি ও ডা. দিলীপ কুমার সাহাকে পুণরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তাদেরকে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতেও বলা হয়।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কমিটির ৫ জন উপদেষ্টার মধ্যে ৩ জন উপদেষ্টা ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যক্ষ অহিভূষণ চক্রবর্তী স্বাক্ষরে সভা ডাকার অনুমতি প্রদান করেন। উপদেষ্টা সদস্য অনিল ঘোষ ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যক্ষ অহিভূষণ চক্রবর্তী সভার অনুমতি দিয়েও ওইদিন দু’জন সভায় উপস্থিত হননি। পরে তাদের অনুপস্থিতিতে সহসভাপতি হরিপদ সাহার সভাপতিত্বে সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে নতুন কমিটি ঘোষণা করেন উপস্থিত সদস্য ও ভক্তবৃন্দরা। মন্দিরের অর্থ আয়-ব্যয় হিসাব স্থানীয় অগ্রণী ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। ভক্তবৃন্দ ও দাতাদের সুবিধাতে বাৎসরিক আয়-ব্যয় হিসাব সহজেই দেখার জন্য মন্দিরের দেওয়ালে টানানো হয়েছে। মন্দিরের ভিতরে প্রায় ৭৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। এছাড়াও নাট মন্দির, শৌচাগার, ফুটওয়্যার, রন্ধনশালা সবকিছুই আধুনিক সাজে সাজানো হয়েছে।
সাবেক সহ-ক্যাশিয়ার দিলীপ সাহা বলেন, মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। সনাতন ধর্মালম্বীদের মাঝে তারা বিভেদ সৃষ্টি করছেন। মন্দিরের আয়-ব্যয় হিসাব সংরক্ষণ করে প্রতি বছর সভার মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। অর্থ তছরুপ করার এখানে কোনো সুযোগ নেই। অগ্রণী ব্যাংক নরসিংদী শাখায় মন্দিরের নামে যৌথ একাউন্ট রয়েছে। অর্থ ব্যয় করতে হলে কমিটির সিদ্ধান্ত এবং যৌথ স্বাক্ষরের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে হয়। মন্দিরের টাকা আত্মসাত এগুলো কিছুই না। মূল কারণ হচ্ছে কমিটিতে স্থান পাওয়া। যদি টাকা আত্মসাত করা হতো তাহলে মন্দিরের এত উন্নয়ন হলো কিভাবে। যারা এধরনের মিথ্যা ও বানোয়াট কথা প্রচার করছেন তারা আসলে কি চায়, তা সকলেই জানেন।
এবিষয়ে পুনরায় নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ডা. দিলীপ কুমার সাহা বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। আমার প্রতি ঈষার্ণিত হয়ে তারা মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তা মনগড়া। কোনো রকম তথ্যপাত্র সংগ্রহ না করে এবং একপক্ষীয় বক্তব্য শুনে এধরণের সংবাদ প্রচার করা দুঃখজনক। সাংবাদিকরা হচ্ছেন জাতির বিবেক। তাদের খেয়ালি প্রণায় যেন অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়। তিনি আরও বলেন ২০১৮ সালে প্রায়ত রঞ্জিত কুমার সাহাকে সভাপতি ও আমাকে সাধারণ সম্পাদক করে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি করা হয়। ওই কমিটির বর্তমানে ৮৩ জন সদস্য রয়েছে। আর বাকিরা পরলোক গমন করেন। তিন বছর পর পর কমিটি করার কথা থাকলেও কোভিড-১৯ এর কারণে আর নতুন করে কমিটি করা সম্ভব হয়নি। পরে চলিত বছরের ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় মন্দিরের ভিতর এক সভায় এক-তৃতীয়াংশ সদস্য ও উপদেষ্টাদের উপস্থিতিতে পুরাতন কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটি করা হয়। এতে আমার কোনো হাত ছিল না। উপস্থিত সকলের মতামতের ভিত্তিতেই নতুন কমিটি করা হয়েছে। আর যিনি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তিনিও পুরাতন কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। তিনি সভা ডাকার অনুমতি দিয়ে তিনিই সভায় উপস্থিত হননি। সভায় উপস্থিত না থাকার কারণ তিনি ভাল বলতে পারবেন। এখন তিনি কয়েকজন লোক নিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করছেন এবং হিন্দু সম্প্রাদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছেন। আর আমার যদি কোনো ভূল বা অর্থ আত্মসাতের মত ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে আসুন বসুন দেখান। দূর থেকে মিথ্যাচার করা অন্যায় ও অপরাধ। এবিষয়ে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও মন্দির কমিটির সদস্য সুব্রত দাস বলেন, এটি একটি দুঃখজনক ঘটনা। এর আগে এ কয়েকজন লোক সত্যেন্দ্র নাথ মোদক সভাপতি থাকাকালীন সময়ে তার বিরুদ্ধেও এমন মিথ্যা অভিযোগ এনেছিলেন। পরে তিনি লোকলজ্জার ভয়ে কমিটি থেকে সরে দাঁড়ান। তিনি আরও বলেন, ডা. দিলীপ কুমার সাহা প্রায় পৌনে ৫ লক্ষ টাকা মন্দিরের দেনা নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ওই টাকা পরিশোধ করে এখন ব্যাংকে প্রায় ১০ লক্ষ টাকার মত জমা পড়ে আছে। আর ভাল মানুষদের প্রতি অমানুষেরা ঈষার্ণিত হবে এটাই স্বাভাবিক।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও কাউন্সিলর অনিল ঘোষ বলেন, আমি একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও হিন্দু সম্প্রাদায়ের নেতা হিসেবে তারা আমার কাছে আসে এবং গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া মন্দির কমিটির বিষয়ে নানা অভিযোগ করেন। পরে আমি কাউন্সিলর হিসেবে সেখানে যাই এবং তাদেরকে শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ করি। উপজেলা নির্বাহী চিঠি দেওয়ার পরও তারা নতুন কমিটি করেছে বলে শুনতে পেয়েছি। যদি এমন ধরনের কাজ করে তাহলে তারা অন্যায় করেছে। আশাকরি দ্রুত সমাধান হবে।