ঢাকামঙ্গলবার , ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
  • অন্যান্য

ধর্ষণ মামলায় ৭ মাসের কারাভোগের পর জামিনে মুক্ত হয়ে তথ্য গোপন করে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান

আজকের বিনোদন
ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৪ ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ । ১৮৬ জন
Link Copied!
দৈনিক আজকের বিনোদন সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি :
নরসিংদীর বেলাব এলাকার চর আমলাব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থাকা অবস্থায় ৮ম শ্রেনীর ছাত্রীকে লাইব্রেরীতে ডেকে নিয়ে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত হন মো. হারুন অর রশিদ মিঞা। ঘটনার পর তা ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা চালালেও ভুক্তভোগীর মা বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রমাণ পায় পুলিশ। পরে ওই মামলায় ৭ মাসের কারাভোগ শেষে জামিনে মুক্ত হয়ে তথ্য গোপন করে ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারী তিনি  গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জের পুনসহী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। কিন্তু এখানেও শিক্ষার্থীদের গায়ে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে হাত দেওয়ার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের অর্থ জালিয়াতি সহ শিক্ষার্থীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার ট্যাব আত্মসাৎ  মত গুরুতর অভিযোগ উঠেছে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটি তাকে গত বছরের ৩০ অক্টোবর প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে বরখাস্ত করলে তিনি গোপনে বিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথী নিয়ে অনুপস্থিত রয়েছেন।
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মো. হারুন অর রশিদ মিঞা (৫০) কাপাসিয়া উপজেলার কামারগাঁও এলাকার মৃত সাত্তার মুন্সির ছেলে।
জানা গেছে, ধর্ষণের অভিযোগে হওয়া সেই মামলাটি এখনও চলমান রয়েছে এবং তিনি তার চার্জশিট ভুক্ত আসামী।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও সাধারণ শিক্ষকদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, হারুণ অর রশিদ মিঞা পুনসহি স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদানের পূর্বে নরসিংদীর বেলাব এলাকার চর আমলাব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন। সেখানে ৮ম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় কারাভোগের পর তথ্য গোপন করে পুনসহি স্কুলে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই স্কুলের শিক্ষকদের নানাভাবে হয়রানির করে আসছিলেন তিনি। শিক্ষকদের থেকে অর্থ আদায়ের লক্ষ্যে তিনি তাদের সনদপত্রসহ যাচাইয়ের নামে হয়রানী শুরু করেন। ইঙ্গিতে তাদের কাছে অর্থ দাবি করে আসছিলেন। যারা এর প্রতিবাদ করেছেন তারাই পরেছেন ওই শিক্ষকের রোষানলে। অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের থেকে অর্থদাবীর মতো জোরালো অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অপর দিকে ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে বিভিন্ন পন্থায় অর্থ আদায় করেছেন বলে জানা গেছে। স্কুল ফি’র বাইরে বিভিন্ন খাত দেখিয়ে ভুয়া রশিদের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করলে তা অভিভাবকদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার করে। পরে শিক্ষার্থীরা স্কুল কমিটির কাছে তাদের দেয়া অর্থের তালিকা দেয়। কিন্তু বিদ্যালয় কমিটিকে তিনি সে টাকার কোন হিসাব দিতে পারেন নি।
এদিকে ঐ শিক্ষক “ভাব” নামে একটি সংগঠনে ছাত্রীদের সুযোগ করে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে আসছিলেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রী অভিযোগ করেছেন। তিনি তাদের গায়ে আপত্তিজনকভাবে হাত দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তারা।
সদ্য বিদায়ী শিক্ষক যোগেশ চন্দ্র সূত্র ধর বলেন, আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ চাকুরী এই স্কুলেই। মাথায় করে মাটি এনে, স্কুল ঘর নিজে হাতে বানিয়েছি। অনেক শিক্ষক এসেছেন আবার চলেও গিয়েছেন। কারো সাথে কখনোই বাদানুবাদ পর্যন্ত হয়নি। এই প্রধান শিক্ষক আসার পরে তিনি আমাকে নানান ভাবে হয়রানী শুরু করেন। আমার অবসরের সময় এলে কিছু কাগজ পত্রে তার স্বাক্ষরের প্রয়োজন পরে। তিনি সেই স্বাক্ষর দিতে হলে তার সাথে একান্তে দেখা করার কথা বলেন। আমি তার কৌশলটি বুঝতে পেরে তার সাথে আর দেখা করিনি। পরে দীর্ঘদিন ঘুরে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে আমি আমার সমস্যার সমাধান করি।
একই স্কুলের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষিকা হাসনা খাতুন জানান, তিনি স্কুলে ১৯৯৮ সন থেকে শিক্ষকতা করছেন। বিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ায় পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞানের ক্লাশ করান নিয়মিত। হারুণ অর রশিদ মিঞা প্রধান শিক্ষক হয়ে এলে তার থেকে অর্থ আদায়ের লক্ষ্যে তার সনদ এবং পত্রিকায় প্রকাশিত যোগদানের সার্কুলেশন দেখতে চান। পরে তিনি ৩ হাজার টাকা খরচ করে ওইসব ম্যানেজ করে তাকে দেখান। পরবর্তীতে তাকে ক্লাশ না নিয়ে বিদ্যালয় করনিকের কাজ করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। পুরো বিষয়টি ওই শিক্ষিকা কমিটিকে অবগত করলে কমিটি তার সমাধান করেন।
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি হাসান মাহমুদ সজিব বলেন, তিনি যোগদানের পর থেকে স্থানীয় কিছু রাজনীতিবীদ এবং কমিটির কয়েকজনকে সাথে নিয়ে দলাদলি শুরু করেন। বিদ্যালয় থেকে ভূয়া রশিদের মাধ্যমে অর্থ আদায় করতে থাকেন। কিন্তু বিদ্যালয়ের আয় ব্যায়ের হিসেবে তা দেখাতে পারেন নি। হিসাব চাইলে উত্তেজিত হয়ে তা দিতে অস্বীকৃতিও জানান। প্রত্যেকটি শিক্ষককে তিনি হয়রানী করেছেন। সকলেই তার আচরনে মারাত্তক ভাবে বিরক্ত। যখন তিনি এখানে যোগদান করেছেন তখন আমরা জানতাম না তিনি ধর্ষণ মামলার আসামী। বেশ কিছুদিন পরে তাঁর পূর্বের কর্মস্থলের পরিচালনা কমিটির লোকজন আমাদের সাথে যোগাযোগ করলে বিষয়টি জানতে পারি। তার বিরুদ্ধে শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী এবং অভিভাবকদের আনা অভিযোগ পরিচালনা কমিটির তদন্তে প্রমানিত হলে মিটিং ডেকে রেজুলেশনের মাধ্যমে তাকে তার পদে স্থগিত ঘোষনা করা হয়। তিনি যাওয়ার সময় বিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথী, শিক্ষার্থীদের সনদপত্রসহ হিসাবের খাতা নিয়ে যান। এ অবস্থায় বিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তার এসব অনিয়মের সকল নথী উপজেলা শিক্ষা অফিস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্য্যালয় সহ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে দাখিল করা হয়েছে।
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মো. হারুণ অর রশিদ মিঞা বলেন, দেখেন আমার স্ত্রী-সন্তান রয়েছে, আমি আশা করবো আপনি সঠিক বিষয়টা লিখবেন। বিদ্যালয় থেকে টাকা তুললে সেটা আমার তোলার কথা না, সেটা তুলবে শ্রেণী শিক্ষক। এ বিষয়ে আমাকে অযথা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা। আমি এর কোন কিছুর সাথেই জড়িত না।
কালীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূর-ই-জান্নাত বলেন, তার নিয়োগের সময় ধর্ষণ মামলার বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। বিষয়টি পরে জেনেছি। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে সকল বিষয় তদন্ত করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এখন ওই শিক্ষকের ব্যাপারে তারা সিদ্ধান্ত দিবেন। একজন ধর্ষণ মামলার চার্জশীট ভুক্ত আসামী স্কুলের দায়িত্ব পালন করতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, সকল বিষয়ের তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে, এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারবো না।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজিজুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে জাতীয় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড এবং আদলতে মামলা হয়েছে। যেহেতু কমিটি এবং প্রধান শিক্ষক আদালতের দ্বারস্ত হয়েছেন সেহেতু বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কিছু বলার নেই। তবে ধর্ষনের দায়ে অভিযুক্ত একজন আসামী স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকতে পারে না।